তারাবো, নারায়নগঞ্জের মাত্র সোয়া কোটি টাকার এক খন্ড জমির মূল্য ৫১৭ কোটি টাকায় পুনর্মূল্যায়নের ফলে গত বছর খানেক সময়ে ইউনুস গ্রুপের মালিকানাধীন সোনালী পেপার এন্ড বোর্ড মিলস নামক পেপার কারখানাটি বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে সোনার ডিম পাড়া শুরু করেছে।
জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো এলাকায় কোম্পানিটি ১ হাজার ১৫০ ডেসিমেল জমি কিনেছিল ১ কোটি ১৩ লাখ টাকায়। কিন্তু নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠান প্রতি ডেসিমেল জমির মূল্য ৪৫ লাখ টাকায় পুনঃমূল্যায়ন করে জমির মোট মূল্য ধরেছে ৫১৭ কোটি ৫ লাখ টাকা। যা আবার বিএসইসি ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ অনুমোধন দিয়েছে।
এছাড়া করোনার প্রভাবে কাগজের চাহিদা মন্দার ফলে কোম্পানীটি কাগজ তৈরি ও বিক্রির চেয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ ও ট্রেডিং এ মনোযোগ দেয়, ফলে কোম্পানীটির প্রকৃত আয়ের চিত্র পাল্টে গেছে। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সোনালী পেপারের ১টি শেয়ারের সম্পদের মূল্য দাড়িয়েছে ২৮৫ টাকা। মাত্র ২১ কোটি টাকা মূল্যের কোম্পানীটির মোট শেয়ারের দাম এখন প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
শেয়ার বাজারের জড়িত কয়েকজনের মতে কোম্পানীটির দামের এই উল্ল্যম্ফন এর মুল কারন এর মোট শেয়ারের মাত্র ২৪ ভাগ অর্থাৎ মোট ৫০ লাখের মতো শেয়ার খোলা বাজারে সাধারণ বিনিযোগ কারীদের হাতে থাকা।
কোম্পানীর এসব আর্থিক চিত্র নিয়ে সম্প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এই কারণে কোম্পানিটির দুই বছরের আর্থিক প্রতিবেদন তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
কোম্পানিটির ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন তদন্ত করার লক্ষ্যে আজিজ হালিম খায়ের চৌধুরী অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসকে ইতোমধ্যে নিয়োগও দিয়েছে বিএসইসি।
এর আগে ২০১৬ সালে সোনালী পেপার এন্ড বোর্ড মিলস লিমিটেড এসএইচ খান অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের মাধ্যমে সম্পদ পুনঃমূল্যায়ন করেছে।
উল্লেখ্য, সোনালী পেপার এন্ড বোর্ড মিলস গত বছর ২৮ জুলাই ওটিসি মার্কেট থেকে মূল মার্কেটে লেনদেন শুরু করে। সেই সময়ে কোম্পানিটি ৩০ জুন, ২০২০ অর্থবছরের জন্য শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দেখিয়েছে ১ টাকা ৬১ পয়সা।
এরপরের বছর অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত ৩০ জুন, ২০২১ অর্থবছরের জন্য কোম্পানিটি ইপিএস দেখিয়েছে ৪ টাকা ৮৯ পয়সা। যা আগের বছরের চেয়ে তিন গুণের বেশি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর’২১) কোম্পানিটি ইপিএস দেখিয়েছে ৬ টাকা ৬৬ পয়সা। আগের বছর যা ছিলো ৬৩ পয়সা। প্রথম প্রান্তিকে ইপিএস বেড়েছে সাড়ে ১০ গুণ।
সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস ১৯৭৭ সালে নিবন্ধিত হয় এবং ১৯৮৫ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৬ সালে ইউনুস গুপ কোম্পানিটি কিনে নেয়।
গত বছর ২৮ জুলাই কোম্পানিটি মূল মার্কেটে সার্কিট ব্রেকারের সর্বোচ্চ ২৪৪ টাকা ৭০ পয়সায় লেনদেন শুরু হয়। এরপর কোম্পানিটির সমাপ্ত অর্থবছরের ইপিএস প্রকাশ করে। এতে কোম্পানিটির শেয়ারে পতন হয় এবং এক পর্যায়ে ২৭০ টাকার নিচে নেমে যায়। এই সময়ে বিএসইসি কোম্পানিটির ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয় ২৭৩ টাকায়। এরপর ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ০৩ জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকে। বহু দিন লেনদেনহীন অবস্থায় থাকে।
এরপর ০৬ জুন বিএসইসি ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে কোম্পানিটির শেয়ারদর ১৯৭ টাকার নিচে নেমে যায়। তারপর শুরু হয় কোম্পানিটির মুনাফায় জোয়ার। মুনাফার জোয়ারের সঙ্গে কোম্পানিটির শেয়ার দরেও জোয়ার শুরু হয়। ৩০ ডিসেম্বর শেয়ারটির দর তোলা হয় ৯৬০ টাকায়। এরপর যারা শেয়ারটির দর আকাশে তুলেছিল, তাদের অফলোড।
এর মধ্যে এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটির দ্বিতীয় প্রান্তিকের ফুলানো-ফাঁপানো ইপিএস প্রকাশ করা হয়। ফুলানো-ফাঁপানো ইপিএস দেখিয়ে সেল প্রেসার আরও বেগবান হয়। যে কারণে ফুলানো-ফাঁপানো ইপিএস প্রকাশ হওয়ার পরও কোম্পানিটির শেয়ার আবারো চাঙ্গা।
এজ এসেট ম্যানেজমেন্ট এর প্রধান নির্বাহী আলী ইমাম বলেন পেশাদার জুয়ারীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সাথে ছোট পেইডআপ ক্যাপিটালের কোম্পানীর শেয়ার নিয়ে খেলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। একটি পর্যায় অতি উচ্চদামে জুয়ারীদের হাতে থাকা শেয়ারগুলো সাধারণ বিনযোগকারীদের কাছে গছিয়ে তারা উধাও হয়। সোনালী পেপারের ক্ষেত্রে এই প্রবনতা দেখা যাচ্ছে।
শেয়ার ব্রোকার, শাহ নেওয়াজ বলেন সোনালী পেপারের আর্থিক বিবরনীগুলো পূর্নমূল্যায়ন করলেই শুভঙ্করের ফাঁকি উম্মোচিত হবে।
সোনালী পেপারের কোম্পানী সচিব রাশেদুল হাসান বলেন কোম্পানীর সকল আর্থিক প্রতিবেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা কতৃক অনুমোদিত। একটি কোম্পানী আর্থিক ভাবে খুব লাভজনক হওয়া কি কোন অপরাধ?